রোজা ভঙ্গের কারণ। যেসব কারনে রোযা ভেঙ্গে যায়

 রোজা ভাঙ্গার কারণ সমূহ!

 


 


কিছু কিছু কাজ রয়েছে, যার কারণে রোজার কোনো রকম  ক্ষতি হয় না। অথচ আমরা অনেকে এসব কারণ গুলোকে রোজাভঙ্গের কারণ মনে করি।


যার ফলে এরকম কাজ হলে রোজা ভেঙ্গে যাওয়া মনে করে আমরা ইচ্ছা করেই পানাহার করে থাকি। আবার কেউ কেউ এসকল কাজ পরিহার করতে গিয়েও অনাবশ্যক কষ্ট ভোগ করে থাকেন।


সুতরাং এসকল বিষয়ে রোযাদারদেরকে অবশ্যই অবগত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। 


যেসকল বিষয় রোযা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ নয়,

তা হল-


০১. অনিচ্ছাকৃত গলায়  ধোঁয়া, ধুলা-বালি কিংবা মশা-মাছি প্রবেশ করলে।



০২. অনিচ্ছাকৃত কানের ভেতরে পানি প্রবেশ করা।

 

০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসলে বা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণে বমি করলে (মুখ ভরে নয়)।


০৪. বমি আসার পরে নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া। 


০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করলে। 


০৬. প্রয়োজন হলে ইনজেকশন নেয়া। 

০৭. ভুল করে পানাহার করে ফেললে। 

০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করলে বা কোনো কিছুর ঘ্রাণ নিলে। 

০৯. নিজের মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গিলে ফেললে । 

১০. গায়ে তেল ব্যবহার করলে। 

১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করলে। 

১২. মিসওয়াক করলে। যদিও মিসওয়াক করার কারণে দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যায়। তবে শর্ত হচ্ছে গলার ভেতরে চলে না যাওয়া। 

১৩. ঘুমের মাধ্যে স্বপ্নদোষ হয়ে গেলে। 

১৪. মেয়ে লোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো উত্তেজনা ছাড়া বীর্যপাত হলে। 

১৫. স্ত্রীকে চুমু খেলে,  বীর্যপাত না হলে। (এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী)। 

১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে  থাকা সামান্য পরিমাণ গোশত গিলে ফেললে ,এর পরিমাণ বেশি হইলে রোজা ভেঙে যাবে। 



এখন আসুন পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে এই বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করি। মনে রাখবেন যে, রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য তিনটি শর্ত আছে-


১. রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

যদি না জেনে রোযা ভঙ্গকারী কোনো একটি রোযা ভঙ্গের কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে রোজা ভাঙবে  না। কারণ আল্লাহ পাক সূরা বাকারায় বলেছেন-


‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করিবেন না, যদি আমরা ভুলিয়া যাই কিংবা কোনো ভুল করিয়া বসি। ’ -সূরা বাকারা : ২৮৬


তখন আল্লাহ পাক বললেন, ‘অবশ্যই আমি তা কবুল করেছি। ’ অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর তোমরা ভুলে যা করে ফেল, তাতে কোনো অপরাধ নেই। অবশ্য ইচ্ছাপূর্বক তোমাদের হৃদয় যা করছে তার ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু। ’ -সূরা আহজাব : ৫


না জানার কারণে রোজা ভেঙ্গে না যাওয়ার বিষয়টি ব্যাপক, হতে শরিয়তের হুকুম সম্পর্কে পারে সে  অজ্ঞ। যেমন, সে ধারণা করল যে এই জিনিসটা কারণে রোজা ভাঙ্গবে না, ফলে তা করে ফেলে। অথবা কাজ করার সময় বা সেটি তার জানা ছিল না। যেমন, সে ধারণা করল যে, ফজর বা সুবহে সাদিক এখনও  হয়নি, ফলে সে পানাহার চালায় অথচ তখন ফজর  হয়ে গেছে। কিংবা সূর্য অস্তমিত হয়েছে মনে করে ইফতার করে ফেলল অথচ সূর্য তখনও অস্তমিত হয় নি। এসকল কারণে রোযা ভেঙ্গে যাবে না। কারণ সহিহ বোখারির হাদিসে এসেছে  হজরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা.)  বলেন, আমরা নবী (সা.)-এর আমলে এক মেঘলা দিনে ইফতার করেছিলাম  তারপর সূর্য দেখা গিয়ে ছিল। ’


এখানে তিনি উল্লেখ করেন নি , নবী করিম (সা.) তাদের এই রোযা কাজা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; কারণ তখন তাদের সময় জানা ছিল না। 


২. রোজার কথা মনে থাকা।


যদি রোজাদার নিজ রোজার কথা ভুলে গিয়ে  রোজা ভঙ্গ হয় এমন কোনো কাজ করে ফেলে তাহলেও তার রোজা শুদ্ধ হবে, পরবর্তীতে তাকে আর সেই রোজা কাজা করতে হবে না। যেমনটি সূরা বাকারার আয়াতে  এসেছে।   তাছাড়া হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে রোজাদার ভুল করে পানাহার করল,  যেন সে  তার রোযা পূর্ণ করে; কেননা আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন। ’

 

নবী করিম (সা.) হতে রোজা পরিপূর্ণ করবার নির্দেশ দেয়া সে রোজা সহিহ হবার স্পষ্ট দলিল। আর ভুলে যাওয়া ব্যক্তির খেয়ে ফেলা ও পান করার সম্পর্ক আল্লাহর দিকে করা প্রমাণিত হয় যে এর ওপর কোনো জবাবদিহিতা নেই। কিন্তু যখনই স্মরণ হয়ে যাবে বা কেউ স্মরণ করে দেবে তখনই: সেটা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে এবং মুখে কিছু থাকলে তাও সাথে সাথে ফেলে দিবে; কারণ এখন তার ওযর দূর  হয়ে গেছে। 



৩. স্বতঃস্ফূর্তভাবে রোজা ভেঙ্গে ফেলা


রোজাদার যদি নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী  রোজা ভেঙ্গে যায় এমন কিছু কাজ করে তাহলে কেবল তার রোজা ভেঙ্গে যাবে । অন্যথায় যদি রোজাদারকে জোর-জবরদস্তি করে রোজা ভাঙ্গার জন্য কিছু খাওয়ানো বা করানো হয় তবে তার রোজা নষ্ট হবে না, তার আর সেটা কাজা করতে হবে  না। কারণ, আল্লাহ কুফুরির হুকুমকে সেই ব্যক্তির  থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন যেই ব্যক্তিকে কুফুরি করতে জোর করে বাধ্য করা হয়, যখন তার হৃদয় ঈমানের ওপর অটল থাকে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘কেউ তার ঈমান আনবার পরে আল্লাহর সাথে কুফরি করলে এবং কুফরির জন্য তার হৃদয় খোলা রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যেই ব্যক্তিকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত। ’ -সূরা আন নাহল : ১০৬

******

সুতরাং যদি আল্লাহ পাক জোর-জবরদস্তি ও বাধ্য করানোর কারণে কুফরির মতো হুকুমকে তুলে দিয়েছেন তাহলে কুফরির চাইতে ছোট অপরাধ তো উঠেই যাবে। অনুরূপভাবে রাসূল সা. বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি এবং বাধ্য হয়ে করা বিষয় ক্ষমা করেছেন। ‘

 

মাসয়ালা : যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সহবাস করতে বাধ্য করে কিন্তু সে রোজাদার, তাহলেও মহিলার রোজা শুদ্ধ হবে। তাকে সেই রোজার কোনো কাজা করা লাগবে  না। যদিও কোনো লোকের জন্য বৈধ নয় স্ত্রীকে রোজা রাখা অবস্থায় সহবাসে বাধ্য করা। আর, যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া নফল রোজা রাখে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ‍


মাসয়ালা : 

চোখের মধ্যে কোনো প্রকার ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। হজরত আনাস (রা.) রোজা রাখা অবস্থায় চোখে সুরমা ব্যবহার করতেন। -আবু দাউদ ১/৩২৩


মাসয়ালা : রাত্রে যদি স্ত্রী সহবাস করলে অথবা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের পূর্বে গোসল করতে না পারলেও রোজার কোনো রকম ক্ষতি হবে না। তবে কোনো কারণ ছাড়া, বিশেষত রোজা রাখা অবস্থায় দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা ঠিক না। 


মাসয়লা : বীর্যপাত  বা সহবাসে লিপ্ত না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে নিজ স্ত্রীকে চুম্বন করা  জায়েয আছে। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হয়  না। তবে যাদের এ আশঙ্কা থাকে তাদের বেঁচে থাকা দরকার। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমরা নবী করিম (সা.)-এর কাছে ছিলাম। ইতোমধ্যে একজন যুবক আসলো এবং প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোজা রাখা অবস্থায় চুমু খেতে  পারি? নবী করিম (সা.) বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ আসল এবং একই প্রশ্ন করল। নবী করিম (সা.) বললেন, হাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একজনের  দিকে আরেকজন তাকাচ্ছিলাম। নবী করিম (সা.) বললেন, আমি জানি, তোমরা কোন কারণে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ লোকটি  নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০


****


মাসয়ালা : অনিচ্ছায়  মুখ ভরে বমি হলেও রোজা ভাঙ্গবে না। তেমনি ভাবে বমি যদি মুখে এসে আমার নিজে নিজেই ভেতরে চলে যায়  তাহলেও  রোজা ভাঙ্গবে না। বলা হয়েছে, অনিচ্ছায় যদি কোনো ব্যক্তির বমি হয় তাহলে  তার রোজা কাজা করতে হবে না। -জামে তিরমিজি: ১/১৫৩, হাদিস : ৭২০


মাসয়ালা : শরীরে বা মাথায় তেলের ব্যবহার  রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। হজরত কাতাদা (রা.) বলেন, ‘রোজা পালনকারীর তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোজার কারণে তৈরী হওয়া ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৪/৩১৩


মাসয়ালা : শুধু যৌন চিন্তা করার কারণে বীর্যপাত হয়ে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। তবে এই কথা বলাই বাহুল্য যে, সকল প্রকার কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহোর কারণ আর রোজা অবস্থায় তো তা আরো বড় ধরণের অপরাধ। কামভাবের সাথে কোনো মহিলার দিকে তাকালে  কোনো ক্রিয়া-কর্ম ব্যতীত বীর্যপাত হয়ে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। তবে রোজা রাখা  অবস্থায় স্ত্রীর প্রতিও এমন দৃষ্টি দেওয়া উচিত নয়।  কু-দৃষ্টি নিশ্চয় কবিরা গুনাহ। যা রোজা রাখা অবস্থায় আরো ভয়াবহ গুনাহর কাজ। এতে রোজা পালনকারীর রোজার ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। হজরত জাবের ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোনো লোক তার স্ত্রীর প্রতি কামভাবের সাথে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত হয়েছে তার রোজা কি ভেঙ্গে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোজা পূর্ণ করবে। ’ –সহিহ বোখারি : ১/২৫৮



মাসয়ালা : মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতরে চলে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না।   ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার  ভেতরে চলে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোজা ভাঙ্গবে না। ’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/৩৪৯


মাসয়ালা : স্বপ্নদোষ হয়ে গেলে রোজা ভাঙ্গে না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৬৪

 

মাসয়ালা :  কান্নার কারণে চোখের  পানি মুখের ভেতর চলে গেলে রোজার তেমন ক্ষতি হয় না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রোজার হালতে সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতরে না চলে যায় তাহলে রোজা ভাঙ্গে না। ’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/২০২


মাসয়ালা : সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করবার পরে যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয় তাহলেও রোজা ভঙ্গ হবে না। হজরত নাফে (রহ.) বলেন, হজরত ইবনে ওমর (রা.) নফল রোজা রাখা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এই কারণে তিনি রোজা ভেঙ্গে ফেলতেন না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৩৫


মাসয়ালা : চোখের মধ্য সুরমা ও ড্রপ ব্যবহার করলে। -(রদ্দুল মুহতার : ৭/৩৭৯৫; ফাতহুল কাদির : ৪/৩২৭; জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ১/২৬)


মাসয়ালা : কোনো প্রকার ইঞ্জেকশন-ইনসুলিন বা টিকা গ্রহন করলে রোজা ভেঙ্গে যায় না, এমনকি গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন নিলেও  রোজার কোনো প্রকার ক্ষতি হয় না। -ফাতাওয়া উসমানি : ২/১৮৬


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ