যাকাতের হিসাব ও মাসায়েলঃ
১। যে সম্পদের যাকাত আসে সে সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দেয়া ফরয। বা সমপরিমাণ মূল্যের কোনো আসবাবপত্র কিনে তার দ্বারাও যাকাত আদায় করা যায়।
২। যাকাত আদায় করার ক্ষেত্রে চাঁদের মাসের হিসাবে বছর ধরতে হবে। কেউ যখন যাকাতের নেছাব পরিমান সম্পদের মালিক হয়ে যায় তখন থেকেই যাকাত আদায়ের বছর শুরু হবে।
৩। স্বর্ণ বা রূপাতে যদি অন্য কোনো কিছু থাকে যেমন ব্রঞ্জ, রাং, দস্তা, তামা ইত্যাদির কোনো কিছু থাকে আর সেসবের মিশ্রণ স্বর্ণ বা রুপার চাইতে পরিমানে কম হয়, তবে সম্পূর্ণটাকেই স্বর্ণ বা রুপা হিসেবে যাকাতের হিসাব করা যাবে - এখানে মিশ্রিত থাকা কোনো ধর্তব্য হবে না। আর যদি মিশে থাকা দ্রব্য স্বর্ণ বা রুপার চাইতে বেশি হয়, তাহলে তা আর স্বর্ণ বা রুপা হিসেবে যাকাত আদায় করা যাবে না।
৪। যাকাতের হিসাব করবার সময় সোনা, রুপা, ও অন্যান্য পণ্যের মুল্য নির্ধারণ করতে হবে তখনকার বাজারের মূল্যের হিসাবে এবং সেসব পন্য অর্থাৎ সোনা, রুপা ইত্যাদি যে জায়গায় আছে সেই জায়গার দাম ধরতে হবে।
৫। শেয়ার করার মূল্য ধরবার ক্ষেত্রে মাসয়ালা হচ্ছে-যারা কোম্পানীর লভ্যাংশ অর্জন করবার জন্য নয় বরং শেয়ার কিনেছেন শেয়ার বেচা-কেনা করার মাধ্যমে লাভবান হওয়াট উদ্দেশ্য, তাহলে তারা শেয়ারের বাজারের মূল্য ধরে যাকাতের হিসাব করবেন। আর যদি শেয়ার কেনার সময় মূল উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানী হতে লভ্যাংশ লাভ করার এবং এর সাথে এই উদ্দেশ্যও থাকে যে, শেয়ারের দর বাড়লে বিক্রি করব, তবে যাকাত হিসাব করবার সময় শেয়ারের বাজার মূল্যের যে পরিমাণ যাকাতযোগ্যের বিপরীতে রয়েছে তার উপরে যাকাত আসবে, অতিরিক্ত অংশের উপর যাকাত আসবে না।
উদাহরন হিসেবে ধরুন শেয়ারের বাজার মূল্য ১০০ টাকা, এর মধ্যে ৬০ % কোম্পানীর বিল্ডিং, মেশিনারিজের বিপরীতে, আর ৪০% কোম্পানীর নগদ টাকা , কাঁচামাল এবং তৈরী মালের বিপরীতে, তাহলে যাকাতের হিসাব করবার সময় শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু অর্থাৎ, ১০০ টাকার মধ্যে ৬০% বাদ হবে। কারণ সেটা এমন সম্পদের বিপরীতে আছে যার উপর যাকাতই আসে না ।তবে অবশিষ্ট ৪০% এর উপর যাকাত আদায় করতে হবে ।
৬। যাকাতদাতার যদি ঋণ থাকে তাহলে যেটুকু ঋণ আছে সে পরিমাণ ঋণের অর্থে বাদ দিয়ে বাকি পরিমাণ অর্থের যাকাত হিসাব করবে। ঋণে পরিমাণ বাদ দেয়ার পর যদি যাকাতের নেছাব পূরণ না হয় তবে সেক্ষেত্রে যাকাত আদায় ফরয হবে না।
৭। কারো কাছে যাকাতদাতার অর্থ পাওনা থাকলে সেই পাওনা অর্থের যাকাত আদায় করতে হবে।
পাওনা হল তিন প্রকারঃ
(ক) কাউকে নগদ অর্থ ঋণ দেয়া হয়েছে বা ব্যবসার কোনো পণ্য বিক্রয় করা হয়েছে আর তার মূল্য পরিশোধ করা হয় নি। এরকম পাওনা ২-৩ বছর পরে উসুল হয় আর পাওনা টাকা এমন পরিমানে হয় যাতে যাকাত আদায় ফরয হয়, তাহলে অতীতের বছরসমুহের যাকাতও আদায় করতে হবে। যদি টাকা একসাথে উসূল না হয়, ভেঙ্গে ভেঙ্গে টাকা উসুল হয়, তবে সেক্ষেত্রে ১১ তোলা রূপার সমপরিমাণ মূল্যের হলে যাকাত আদায় করতে হবে। তার চাইতে কম পরিমাণ টাকা উসূল হলে তার যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হবে না। তবে অল্প অল্প করে সেই পরিমাণে যদি পৌছে যায় তাহলে যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হবে। আর যখনই যাকাত ওয়াজিব হবে তখনই অতীতের সকল বতসরের যাকাত আদায় করতে হবে । আর যদি এরকম পাওনা অর্থ নেছাব পরিমাণের চেয়ে কম হয় তাহলে তাতে যাকাত আদায় করা ওয়াজেব হবে না।
(খ) নগদ অর্থ ঋণ দেয়ার জন্যে অথবা ব্যবসায়ের কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করবার কারণে টাকা পাওনা নয় বরং ঘরে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড়, চাষের গরূ ইত্যাদি বিক্রি করা হয়েছে এবং এর দাম পাওনা আছে , এমন পাওনা টাকা যদি নেছাবের সমপরিমাণ হয় এবং তা যদি কয়েক বছর পরে উসূল হয় তাহলে ঐ কয়েক বছরের যাকাত আদায় করতে হবে। তা যদি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উসুল করা হয় সেক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ মূল্য না হবে ততক্ষন যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হবে না। যখন উপরের পরিমাণে উসূল হয়ে যাবে তখন বিগত বছরের যাকাত আদায় করতে হবে।
(গ) মোহরের অর্থ , বখশিশ এর অর্থ , বেতনের টাকা ইত্যাদি কারো কাছে পাওনা থাকলে এরকম পাওনা টাকা উসূল হবার আগে যাকাত আদায় করা ওয়াজিব হয় না। উসূল হবার পরে ১ বছর উক্ত অর্থ মজুদ থাকলে তখন যাকাতের হিসাব শুরু হবে। পাওনা অর্থের যাকাত আদায় করা সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বর্ণিত শুধু মাত্র তখনই প্রযোজ্য হবে যখন এই অর্থ ছাড়া তার কাছে যাকাত দেয়ার মত অন্য কোনো অর্থ/সম্পদ না থাকবে। আর অন্য কোনো সম্পদ থেকে থাকলে তার মাসলা আলেম উলামাদের কাছ থেকে জেনে নিবেন।
৮। যে ধার দেয়া অর্থ ফেরত পাবার কোন আশা নাই, এরকম পাওনার উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয় না। যদি পেয়ে যায় তবে বিগত বছরসমূহের যাকাত আদায় করতে হবে।
৯। যৌথ কারবারে টাকা বিনিয়োগ করা থাকলে যৌথভাবে সম্পূর্ণ টাকার যাকাত হিসাব করতে হবে না বরং প্রত্যেকের অংশের জন্য প্রত্যেকের নিজস্ব ভাগের আলাদা হিসাব করতে হবে।
১০। যেসকল স্বর্ণ, রৌপ্যের অলংকার স্ত্রীর মালিকানায় থাকে সেটাকে স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে হিসাব করা হবে না বরং একান্তই সেটা স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আর যেসকল অলংকারসমূহ স্ত্রীকে শুধু মাত্র ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয়, এর মালিক থাকে স্বামী, তবে সেটা স্বামীর সম্পত্তি হিসেবে ধরে হিসাব করা হবে। আর যেসবের মালিকানা অস্পষ্ট তা স্পষ্ট করা উচিত। যেসকল অলংকার স্ত্রীর নিজস্ব ব্যক্তিগত সম্পদ থাকে, যেগুলো বাপের বাড়ি হতে পায় , সেগুলো স্ত্রীর সম্পদ হিসেবে ধরা হবে।
মেয়েকে যেই অলংকার দেওয়া হয় সেইটার ক্ষেত্রেও মেয়েকে মালিক বানিয়ে দেওয়া হলে সেটার মালিক সে। আর শুধু মাত্র ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হলে মেয়ে সেই অলংকারের মালিক নয়। নাবালেগা ছেলে বা মেয়ের বিয়ের ব্যয় করার জন্য তাদের নামে ব্যাংকে বা ব্যবসাতে যেই অর্থ বিনিয়োগ করা হয় সেটার মালিকও সেই ছেলে বা মেয়ে । অতএব সেগুলোকে মা-বাবার সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং মা-বাবার যাকাতের হিসাবের সময় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। আর বালেগ হওয়া সন্তানের নামে শুধু অলংকার বানিয়ে রাখলে বা টাকা বিনিয়োগ করলেও তারা মালিক হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা সেই সন্তানের দখলে থাকবে । নাবালেগা মেয়ে বা নাবালক ছেলের দখলে দেওয়া হলে তারা উভয় মালিক হিসাবে গণ্য হবে , অন্যথায় তার মালিক হবে তাদের পিতা/মাতা।
১১। হিসাবের চাইতে কিছু বেশি পরিমাণ যাকাত আদায় করা উত্তম। এতে কোনো রকম কম হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। প্রকৃতপক্ষে, সেটুকু পরিমাণ যাকাত যদিও না হয়, তাতে সে দানের ছওয়াব পেয়ে যায় ।
★সূত্রঃ আহকামে যিন্দেগী ।

0 মন্তব্যসমূহ